আমার শহরে কয়েকদিন

কিছু গল্পের শুরুটা খুব আচমকাই হয়। এতটাই আচমকা যে গল্পের  প্রধান চরিত্ররাও এর সম্ভাব্য গতিপথ এবং পরিণতির সম্পর্কে কিছুই টের পায় না। গল্প তার নিজস্ব গতিতে পাতার পর পাতা এগিয়ে চলে। শব্দের পর শব্দ, বাক্যের পর বাক্য; মনে হয় বইয়ের সাদা পাতাগুলোয় কেউ যেন অনুভূতির তাজমহল তৈরি করছে।
       তবে সব গল্পের পরিণতি কিন্তু উপন্যাস হয় না। তারা চিরকাল ছোটগল্পের মতই স্বল্প পরিসরে বেঁচে থাকে।
শেষ হয়েও তারা শেষ হয় না আজীবন; ফুরিয়ে যাওয়া তারার আলোয় জ্বলতে থাকে টিমটিম করে।

                                 (১)
গোটা চোদ্দ স্টলে ঘোরার পর চূড়ান্ত ক্লান্ত হয়ে ফুডকোর্টের সামনের শান বাঁধানো বেদিটার উপর বসলো মিথিল। আপাতত খানদুয়েক বই কিনে ফেলেছে ও। তবে উইশ লিস্টের আর‌ও অনেক বই বাকি রয়েছে এখন‌ও। একটু জিরিয়ে নিয়ে তারপর আবার শুরু করবে সে তার বইমেলা অভিযান।
      আজ বইমেলায় ভিড়টা কিঞ্চিৎ বেশি। তার অবশ্য দুটি কারণ রয়েছে। প্রথমটি হল আজ রবিবার, আর দ্বিতীয়টি হল আজ বইমেলার শেষ দিন। তাই সবাই যে যার প্রিয় বই এবং লেখক লেখিকাদের কাছাকাছি আসতে ছুটে এসেছেন সল্টলেক সেন্ট্রাল পার্কে।

     সেই ছোটবেলা থেকেই মানুষ দেখতে বড্ড ভালোবাসে মিথিল। এক একটা মানুষ এক একটা চরিত্র; তাদের প্রত্যেকেরই একটা করে গল্প রয়েছে। মিথিল খুব চেষ্টা করে সেই গল্পগুলো খোঁজার।
      রাস্তাঘাটে, হাটে-বাজারে সর্বত্রই বহু মানুষই দেখে সে; কিন্তু কয়েকজন মানুষের দিকে তাকালে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে হয়। ওই চোখ আটকে যাওয়া যাকে বলে আর কি! তেমনই একজনকে ও দেখছে এখন। 
       নীল রঙের চুড়িদার পরিহিতার ডান হাতে বেশ কিছু বইয়ের প্যাকেট, কাঁধে ভ্যানিটি ব্যাগ। বাঁ হাত দিয়ে তিনি তাঁর সাদা ওড়নাটির দ্বারা চেষ্টা করছেন কপালের বিন্দু বিন্দু ঘামগুলিকে মুছে ফেলতে। সেই চেষ্টা করতে করতেই তিনি এগিয়ে আসছেন শান বাঁধানো বেদিটির দিকে।
    মিথিলের থেকে খানিক দূরত্ব বজায় রেখেই তার পাশে বসলেন সেই নীল চুড়িদারের মালকিন। তারপর নিজের সদ্য কেনা ‘অন্য বসন্ত’ বইটি আনন্দের লাল ব্যাগটি থেকে বার করলেন।
প্রথম পাতাটি খুব মনোযোগ সহকারে পড়ছিলেন তিনি; আর ঠিক তখনই মিথিল নিজের অপ্রত্যাশিত রিফ্লেক্সের তাড়নায় বলে বসে, “সিনেমার শুরুটার সাথে মিল আছে কিনা মিলিয়ে দেখছেন বুঝি?”

কথাটি বলা তার ঠিক হল না ভুল, তা ভাবার অবকাশ মিথিল পেল না, তার আগেই সেই তনয়া বেশ অবাক হয়েই তাকিয়েছেন মিথিলের দিকে। তারপর নিজের ঘেমো নাকে পিছলে যাওয়া ফাইবার ফ্রেমের চশমাটিকে আঙুল দিয়ে ওপরে তোলার ব্যর্থ চেষ্টা করে তিনি বললেন, “আপনি কী করে বুঝলেন?”
মিথিল হেসে বললো, “না আসলে আমিও খানিকটা আপনার মতো করেই মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করেছিলাম তো, তাই মনে হল।”


মিথিলের কথায় এবার মৃদু হাসলেন তিনি। তারপর বললেন, “আসলে বইটা কেনার ইচ্ছে ছিল বহুদিন, কিন্তু কেনা হয়ে ওঠেনি। সেদিন ইউটিউবে সিনেমাটা দেখার পর ইচ্ছেটা অনেকটাই বেড়ে যায়। ব্যস, কিনে ফেললাম!”
মিথিল বলল, “তা ভালোই করেছেন। ইচ্ছেদের দমিয়ে রাখা খুব একটা কাজের কথা নয়।” কথাটা শেষ করেই ওরা দুজনে একসাথে হেসে উঠল।
এই সেই কথাবার্তায় মিথিলের সাথে আলাপটা বেশ ভালোই জমল তৃষার। একে অপরের নাম জানাজানি হওয়ার পর আপনিটাও বড়ই অল্প সময়ের মধ্যে তুমি হয়ে গেল।
“তা' তোমার এই নিয়ে ক'বার হলো এবার বইমেলায়? আমার কিন্তু বার তিনেক হল।” মিথিল চোখ টিপলো।
তৃষা মুচকি হেসে বলল, “একবারই। ইনফ্যাক্ট এটাই আমার প্রথমবার কলকাতা বইমেলায়।”
“ওহ...তুমি কি কোলকাতার বাইরে...!” মিথিলের কথা শেষ হওয়ার আগেই তৃষা বলল, “আজ্ঞে হ্যাঁ মিথিলবাবু। সুদূর কালিম্পংয়ের বাসিন্দা আপনার এই নতুন বান্ধবী।”
“এখানে কোথায় উঠেছো?” মিথিল জিগ্যেস করল।


তৃষা বলল, “কয়েক বছর হল আমার ছোটপিসি কোলকাতায় ফ্ল্যাট কিনেছেন। ছোটবেলা থেকেই ইচ্ছে ছিল তোমাদের শহরে একবার আসার। কিন্তু সু্যোগ কোন‌ওদিন হয়নি। কয়েকদিন আগে পিসি যখন ডাকল ফোন করে, তখন আর না করলাম না। ব্যস, চলে এলাম স্বপ্নের শহর কলকাতায়।” একটানা বলে থামল তৃষা।
“তোমার তো দেখছি কলকাতা নিয়ে দারুণ অবসেশন।” মিথিল বলল।
তৃষা নাকের পিছলে যাওয়া চশমাটিকে ঠিক আগের মতই তুলে ধরার ব্যর্থ চেষ্টা করে বলল, “তা খুব একটা ভুল বলোনি। কখন‌ও না আসা এই শহরটা ছোটবেলা থেকেই আমার বড্ড চেনা। বিভিন্ন গল্প, উপন্যাসের হাত ধরে, তাদের চরিত্রদের বন্ধু পাতিয়ে বহু দিনরাত এই শহরের অলিতে-গলিতে, রাস্তা-ঘাটে ঘুরে বেরিয়েছি।” কথাগুলি শেষ হতেই মিথিল দেখল তৃষার চোখমুখ কোনো এক অদ্ভুত মুগ্ধতায় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। একটা স্বল্প কিন্তু ভীষণ রকম হৃদয়বিদারক হাসি খেলে গেছে তার ঠোঁটে। এমন হাসি তার হাসা উচিত নয়; এতে কিন্তু বহু গোলমালই ঘটে যেতে পারে তার অজান্তে।
“তবে আমার বোধহয় এবার কলকাতা ঘোরা হবে না।” তৃষার কথায় চমক ভাঙল মিথিলের। সে গোধূলির ফুরিয়ে যাওয়া আলোয় তৃষার ম্লান মুখটা দেখলো আরও একবার। কই, এমন স্নিগ্ধতা সে তো আর কারোর মধ্যে দেখেনি কখনও।
“আমার পিসতুতো দাদা বলেছিল আমায় কলকাতা ঘোরাবে। কিন্তু এসে শুনলাম তার অফিসে নাকি সাতদিনব্যাপী কী একটা কনফারেন্স আছে, তাতে তাদের অফিসের তাবড়-তাবড় সব ক্লায়েন্টরা আসবেন। তাই তার ছুটি ক্যান্সেল হয়ে গেছে।” দীর্ঘশ্বাস ফেললো তৃষা। তারপর আবার বলল, “জানো মিথিল, বইমেলাটা আসতে পারলাম কারণ পিসির বাড়ির সামনে থেকে ডিরেক্ট বাস আছে এখানের। ফেরার সময়ও সেই বাসেই ফিরব। কিন্তু প্রথমবার কোলকাতা এসে একা একা কলকাতা ঘোরা যায় বলো?”
“হ্যাঁ তা ঠিকই বলেছ! তবে তোমার অসুবিধে না থাকলে, আমি তোমায় কলকাতা ঘুরিয়ে দেখাতে পারি।” মিথিল মুখটা ওই দূরের অরণ্যমন প্রকাশনীর স্টলের দিকে তাকিয়ে কথাটি বলল।
তৃষা বলল, “বাহ রে... তুমি তোমার সমস্ত কাজকর্ম ফেলে আমায় কলকাতা ঘোরাবে?”
মিথিল এবার মুখটা তৃষার দিকে ফিরিয়ে বলল, “আজ্ঞে না। এত মহান আমি নই। তবে ইদানীং তোমার এই সদ্য পাতানো বন্ধুটি একদম বেকার। চাকরি একটা করতাম তবে ভালো লাগেনি তাই ছেড়ে দিয়েছি। আপাতত সন্ধ্যেবেলায় গুটিকয়েক টিউশনি ছাড়া বান্দা একদম ফ্রী!” কথাটি বলেই চার্লি চ্যাপলিনের ভঙ্গিমায় চোখ টিপলো মিথিল।
তৃষা খিলখিল করে হেসে উঠলো মিথিলের কথায়। তারপর মধুর কণ্ঠে গেয়ে উঠল,

        ❝খুঁজে দিতে না পারলে আড়ি,
           আমার ব্যোমকেশ বক্সীর বাড়ি!
           তবেই তোমার কথা,
          কলকাতা কলকাতা,
          সবকিছু মেনে নিতে পারি।❞

উত্তরে মিথিলও হেঁড়ে গলায় গেয়ে উঠল,


     ❝কেন এ অসম্ভবে, 
     ডেকে আনো আমাকে....
     ছুঁয়ে থাকো হাতটাকে, 
     কবিতার ছাদটাকে।❞

                                   (২)
এই হোয়াটসঅ্যাপ এখন এক অদ্ভুত যন্ত্র। কয়েক দশক আগে যে আলাপটুকু হতে প্রায় কয়েক মাস লেগে যেত আজ তা প্রায় কয়েক দিনেই হয়ে যায়। মিথিল আর তৃষার আলাপটাও তার ব্যতিক্রম হল না।
ওরাও কয়েকদিনের মধ্যেই নিজেদের মধ্যে বেশ ঘুলেমিলে গেছে। তুমিটাও ইতিমধ্যেই নেমে এসেছে তুইতে। সারাদিনের এই বকম বকমে ক্লান্তি নেই একটুও।
একটা নতুন বন্ধুত্ব ওই অনেকটা নতুন একটা বই পড়ার মতই। প্রতি পাতায় পাতায় লুকিয়ে থাকে অমোঘ এক আকর্ষণ।
                             ******

       ❝সুতানটি ছোটাছুটি, টালি থেকে টালা,
       ওল ঢোল এগরোল জুঁইফুল মালা!
      লেনিনের পাদদেশে প্রণামির থালা,
            তবু পরি ঘোরে ভিক্টোরিয়ায়!
      যাক উড়ে যাক, দুধে-ভাতে থাক,
     কলকাতা কলকাতাতেই, আমার শহর!❞


“এই তবে সেই ভিক্টোরিয়া! কত গল্প উপন্যাসে পড়েছি এখানকার কথা, সিনেমায় দেখেছি। আজ প্রথম দেখলাম সামনে থেকে।” তৃষা বলল।
মিথিল মুচকি হেসে বলল, “আমার দেখে দেখে পচে গেছে। তোর প্রথমবার তাই এত মুগ্ধতা।”
“হুহ! কথায় আছে না, গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না।” তৃষা মুখ বেঁকিয়ে বলল। তারপর মিথিলের খুব কাছে গিয়ে ফিসিফিসিয়ে জিজ্ঞেস করল, “এই এখানে নাকি সেসবও হয়?”
মিথিল চোখ টিপে জিজ্ঞেস করল, “কোন সব?”
“থাক আর ন্যাকামো করতে হবে না, উল্লুক কোথাকার। ভাবটা এমন দেখাস যেন ভাজা মাছটা উলটে খেতে পারিস না। গাধা একটা।” মিথ্যে রাগেও তৃষার ফর্সা নাকটা লাল হয়ে গেল। তাই দেখে মিথিল হোহো করে হেসে উঠল।
                                **********
“আচ্ছা তৃষা তুই কখনো কাউকে চুমু খেয়েছিস?” মিথিল ভিক্টোরিয়ার বিশালাকৃতি মাঠের খুব ক্ষুদ্র একটি অংশ থেকে অকাতরে দু'চারটি ঘাস উচ্ছাদন করতে করতে জিজ্ঞেস করল। প্রশ্নটি অত্যন্ত ব্যক্তিগত হলেও মিথিলের মনে হল এটুকু জিজ্ঞেস করার মত বন্ধুত্ব ওদের হয়েছে।
মিথিলের প্রশ্ন শুনেই এক অজানা কারণে থমকে গেল তৃষা। তারপর মুখটা দূরের ভিক্টোরিয়া মিউজিয়ামের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে বলল, “হুম। একবার নয়, বহুবার।”
তৃষার উত্তরে বুকটা কেমন যেন থমথমে হয়ে গেল মিথিলের। দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলা মনের শতাব্দী এক্সপ্রেসটার যেন হঠাৎই টায়ার পাংচার হয়ে গেল। মেঘমুক্ত নীল আকাশে ফুরফুরিয়ে উড়তে থাকা গ্যাস বেলুনটায় আচমকাই কেউ যেন হিলিয়ামের জায়গায় ভরে দিয়েছে অনেকখানি ইঁট-বালি-পাথর। অভিকর্ষের টানে ক্রমশই সেটি ধেয়ে আসছে বাস্তবের মাটির দিকে।
ক্লাস টুয়েলভের পর নিউটনের প্রতি আবার নতুন করে ঘৃণা হল তার।
মিথিলের আবারও মনে হলো যদি আপেলটি না পড়ে পুরো গাছটিই....!
“কী রে হাঁ করে কী দেখছিস তখন থেকে?” তৃষার ডাকে সম্বিত ফিরল মিথিলের। ও হেসে উত্তর দিল, “না কিছু না। তা কে সেই হতভাগা যে তোর পাল্লায় পড়েছে?”
তৃষা আবার মুখ বেঁকিয়ে বলে, “আছে একজন। আমার ছোটবেলার সঙ্গী, আমার বেটার হাফ ফর এভার।”
“বাহ দারুণ ব্যাপার। বলিসনি তো কখনো?” মিথিল জিজ্ঞেস করল।
“সুযোগ হল কই বল! তুইও তো আগে জিজ্ঞেস করিসনি।” তৃষা উত্তর দিল।
মিথিল এবার একটা নিঃশব্দ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “সেই! ক'দিনের বা আলাপ তোর সাথে!”
“হুম সেই তো! এবার তুই বল, তুই কাউকে চুমু খাসনি কখনো?” তৃষা পালটা প্রশ্ন করে।
মিথিলের ঠোঁটে খেলে যায় এক ব্যর্থ, পরাজিত হাসি। সে গুন গুন করে গেয়ে ওঠে,

         ❝এই দিনের আঁচলে ভাসে খড়কুটো,
           আমি দেখি তুমি সামলাও ঝড় মুঠো,
           আর না পাওয়া দুজন জানে চুম্বন অর্থহীন।❞

                                    (৩)
“বিকেলের এই মরে যাওয়া রোদ্দুরে গঙ্গার ধারটা কী অপরূপ সুন্দর লাগে তাই না?” তৃষা ওর পাশেই তাল মিলিয়ে হাঁটতে থাকা মিথিলের দিকে তাকিয়ে বলে কথাটা।
মিথিল আলতো হেসে বলে, “ঠিক। আমার মন খারাপ হলেই এখানে চলে আসি জানিস। বিকেলবেলায় এখানে একটা অদ্ভুত মিষ্টি হাওয়া দেয়। মন ভালো করা একটা হাওয়া; অনেকটা ওই সিওসি গেমের হিলিং স্পেলের মত। সবটা কেমন যেন হিল করে দেয়!”
“উফ তোদের এই একটা গেম হয়েছে বটে! কী যে খেলিস তোরা আমার তো কিছুই মাথায় ঢোকে না। শুভটাও খুব খেলতো প্রথম প্রথম, তবে পড়াশোনার চাপে বন্ধ করে দিয়েছে।” তৃষা বলল।
তৃষার কথা শুনে মিথিল নিজের গলাটা অবিকল অনির্বাণ ভট্টাচার্যের মত করে বলে, “শেষ কয়েকদিন তোর কাছে শুভর এত কথা শুনেছি যে ওর সম্পর্কে জানার জন্য ব্যাপক মাত্রায় কৌতূহল হচ্ছে আমার।”
“কীরকম কৌতূহল?” তৃষা জিজ্ঞেস করে।
“এই এখন যেমন আমার ভীষণ জানতে ইচ্ছে করছে যে শুভ মানুষটা ঠিক কেমন?” মিথিল চোখ টেপে।
“শুভ খুব ভালো ছেলে। প্রচন্ড ব্রিলিয়ান্ট, পড়াশোনা কেরিয়ার নিয়ে চূড়ান্ত ফোকাসড। আইআইটি খড়গপুর থেকে পড়ছে। আর লুকস নিয়ে তো কিছু বলার নেই ভাই। ওকে আমাদের স্কুলের লিওনার্দো দি ক্যাপ্রিও বলা হত।” তৃষা বেশ গর্ব করে বলল।
মিথিল মুখ গোমড়া করে বলল, “নাহ, ঠিক বোঝা গেল না।”
“মানেটা কী? হুম?” তৃষা চোখ রাঙায়।
মিথিল হাতজোড় করে বলে, “কিছু না মা... ক্ষ্যামা দে। এবার চল সামনের দিকে হাঁটি।”
তৃষার কিছু বলে না; খালি ওর সেই গণ্ডগোলের হাসিটা আরও একবার মিথিলের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে এগিয়ে চলে সে।
                                  ********
গঙ্গার পাড়ে দাঁড়িয়ে শহরের বুকে সন্ধ্যে নামতে দেখার এক অদ্ভুত ভালোলাগা আছে। সেই ভালোলাগায় কিছুক্ষণের জন্য হলেও ভুলে থাকা যায় দৈনন্দিন যন্ত্রণাগুলো। যদিও মাঝেমধ্যে ভালোলাগাটুকুও যন্ত্রণা বয়ে আনে। সে যন্ত্রণা যতই প্রত্যাশিতই হোক না কেন, মানুষ চিরকাল যন্ত্রের মতই সেই সমস্ত যন্ত্রণার দিকেই ছুটে যায়।
“কাল আমি চলে যাচ্ছি মিথিল, তোর শহর ছেড়ে।”
“জানি।”
“কলকাতায় না এলে জানতেও পারতাম যে তোর মতোও ছেলে হয়। মানে আমি ভাবতাম ছেলেরা বোধহয় সবাই শুভর মতই! আর বাকিদের অস্তিত্ব শুধুমাত্র উপন্যাসের পাতায়। কিন্তু তোকে দেখে সব কেমন গুলিয়ে গেল জানিস?”
“হুম!”
“তোর আমায় মনে পড়বে মিথিল?”
“ধুস, একটুও না। কদিনেরই বা আলাপ তোর সাথে!”
তৃষা মিথিলের চোখের কোল থেকে নিজের তর্জনীর ডগায় তুলে আনে কয়েকফোঁটা মণিমুক্তো।
“তাহলে এগুলো কী মিথিল?”
“ওটা চোখে কিছু একটা পড়েছে তাই। তুই কি ভাবলি....?”
“তুই এত প্রেমকাতুরে কেন?”
“মোটেই না।”
“মিথ্যে যখন পারিস না বলতে, তাহলে বলিস কেন!”

মিথিল উত্তরে আরও কিছু বলার চেষ্টা করতো, কিন্তু পারল না। তৃষা হঠাৎ ওর কলারটা ধরে ওকে নিজের খুব কাছে টেনে নিল। চোখদুটো আনমনেই বুজে গেল মিথিলের। তৃষার উষ্ণ নিশ্বাস ও নিজের ঠোঁটের উপর অনুভব করছে ক্রমশ।  চারিদিক হঠাৎ ভরে উঠেছে বেয়াড়া পেপার মিন্টের গন্ধে। বুকের ধুকপুকানিটা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে।  বাহাত্তর কে পাঁচ, সাত, কিংবা দশ দিয়ে গুণ করলে কত হয় জানে না মিথিল; জানতেও চায় না সে। সে শুধু জানে যে এই মুহূর্ত, এই স্পর্শ, এই ভালোলাগাটুকু একান্তই তার নিজের। হয়তো পরের মুহূর্তেই ধেয়ে আসবে একজীবন ব্যর্থতা। তবুও এই  টুকরো সময়টুকু নাহয় তার হয়ে থাকল চিরকালের জন্য।
যদি আবার কখনো মিথিলের দেখা হয় তৃষার সাথে! তৃষা যদি জিজ্ঞেস করে ওকে,
             ❝আমাদের গেছে যে দিন
             একেবারেই কি গেছে,
               কিছুই কি নেই বাকি?❞
মিথিলও কী তখন রবি ঠাকুরের মতন করেই বলবে,
      ❝রাতের সব তারাই আছে
       দিনের আলোর গভীরে।❞

                                (৪)
কোনো এক শনিবার শিয়ালদহ স্টেশন থেকে উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেস ছাড়ল নীরবে।
কোন‌ও এক শনিবার দক্ষিণ কোলকাতার একলা চিলেকোঠায় ময়লা বালিশ ভিজলো চোখের জলে।
কোন‌ও এক শনিবার কোলকাতা আর কালিম্পঙের দূরত্বটা বেড়ে গেল অনেকখানি।
তাহলে কি গল্পটি অসমাপ্তই রয়ে গেল?
নাকি ছোটগল্পের মতই শেষ হয়েও শেষ হল না আজীবন!

                               (সমাপ্ত)


ঋণঃ অনুপম রায়, চন্দ্রবিন্দু, দেবদীপ, সুচিত্রা ভট্টাচার্য এবং সবশেষে আপামর বাঙালির প্রত্যেকটি অনুভূতির কাণ্ডারী রবি ঠাকুর।

Comments